চট্টগ্রাম বন্দরে সহীদ হাসানের দাপট: সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান ও বন্দর সচিব ওমর ফারুকের ছায়ায় গড়ে ওঠা দুর্নীতির সাম্রাজ্য

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশের সময়: বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২৫ । ৬:৪৩ অপরাহ্ণ

 

 

অনুসন্ধানী প্রতিবেদক :

চট্টগ্রাম বন্দর—বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। অথচ এই কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে মাদারীপুরের এক তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী ছৈয়দ সহীদ হাসানের ইশারায়।

তার পেছনে শক্ত পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন সাবেক নৌপরিবহণ মন্ত্রী শাহজাহান খান এবং বর্তমান বন্দর সচিব ওমর ফারুক। তাদের প্রভাবে গত ১৪ বছর ধরে সহীদ হাসান বন্দরে গড়ে তুলেছেন দুর্নীতি ও ক্ষমতার এক অঘোষিত সাম্রাজ্য।

১৯৯৬ সালে জুনিয়র একাউন্টস এসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগদান করা সহীদ হাসান পরে ১৩তম গ্রেডের উচ্চ হিসাব সহকারী হন। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার রাজনৈতিক ভাগ্য খুলে যায়।

কারণ তিনি ছিলেন মাদারীপুরের এমপি ও নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খানের ভাশুর। এই সম্পর্কের জোরে তিনি নিয়ম ভেঙে চট্টগ্রাম বন্দরের ১১তম গ্রেডের লিয়াজু অফিসারের দায়িত্ব দখল করেন। ১৩তম গ্রেডের কর্মচারীর জন্য এই পদ পাওয়া আইনত অসম্ভব; কিন্তু সহীদ হাসানের ক্ষেত্রে সব নিয়মই অকার্যকর হয়ে যায়।

এরপর থেকেই তিনি ঢাকাস্থ লিয়াজু অফিস এবং মন্ত্রণালয়–বন্দরসংক্রান্ত সব কাজের নিয়ন্ত্রণ নেন। ধীরে ধীরে তিনি নিয়োগ, পদোন্নতি, টেন্ডার ও বন্দর–মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিজের হাতে নিয়ে নেন। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে তাকে সবাই ‘শাহজাহান খানের এজেন্ট’ বলে চিনত।

২০১১ সালে লিয়াজু অফিসারসহ বেশ কয়েকটি পদে কর্মকর্তা নিয়োগ পেলেও সহীদ হাসান কাউকেই ঢাকায় কাজ করতে দেননি। বছরের পর বছর পদগুলো ফাঁকা রেখে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখেন। ২০২২ সালে নতুন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি লিখিত পরীক্ষায় মাত্র –৬.৫ নম্বর পেয়ে অকৃতকার্য হন।

ডিজিটাল টপশীট ও QR কোডভিত্তিক ফলাফল হওয়ায় ফল পরিবর্তনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপরও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ প্রয়োগ করে তিনি নিজেকে বহাল রাখেন।

একই পদে ২ জনকে পদায়নের নজিরবিহীন ঘটনায় প্রকৃত লিয়াজু অফিসার সাজ্জাত হোসেনকে ২০২4 সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামে ফেরত পাঠানো হয়। কারণ তিনি বন্দর সচিব ওমর ফারুক ও সহীদ হাসানের দুর্নীতিতে সহযোগিতা করেননি।

ঢাকায় সহীদ হাসানের রয়েছে বিলাসবহুল জীবনযাপন। তিনি রাজকীয় ফ্ল্যাটে থাকেন, চট্টগ্রাম বন্দরের একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন। পরিবারের কাজে নিয়মিত সরকারি গাড়ি ও জ্বালানি ব্যবহার করে তিনি প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার ভুয়া বিল তৈরি করেন।

মন্ত্রণালয়ে ভুয়া সভার খরচ দেখিয়ে ৩–৪ লাখ টাকা পর্যন্ত উত্তোলন করেন। এসব বিল অনুমোদনে মুখ্য ভূমিকা রাখেন বন্দর সচিব ওমর ফারুক। তাদের দুর্নীতি এতটাই প্রভাবশালী যে ঢাকায় যাওয়া বন্দরের কর্মকর্তারা অফিসিয়াল কাজেও গাড়ির সুবিধা পান না।

বন্দর সচিব ওমর ফারুক নিজেও বন্দরে নিয়োগ, পদোন্নতি ও টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। বিদেশে সন্তানদের পড়াশোনার নামে বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার ভাগ্নের নামে ঠিকাদারি ব্যবসা পরিচালিত হয় বন্দরের বিভিন্ন বিভাগে।

সহীদ হাসান তার হয়ে ঢাকায় সকল ‘সংবেদনশীল কাজ’ সামলান।

২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি সহীদ হাসান আরও এক নিয়ম ভেঙে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব নেন—যা কখনোই তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর পক্ষে পাওয়ার কথা নয়।

তাকে সহায়তা করেন বন্দর সচিব ওমর ফারুক ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নজরুল ইসলাম আজাদ। ঢাকার রেস্ট হাউজ পর্যন্ত তার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে।

অভিযোগ আছে, জেলে থাকা সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খানকে নিয়মিত অর্থ পাঠান সহীদ হাসান এবং তার পরামর্শেই এখনো নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনেক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

যখন দেশে ফ্যাসিবাদী শক্তির দৌরাত্ম্য কমে গেছে, তখন চট্টগ্রাম বন্দরে এখনো তাদের দোসররা একচ্ছত্র ক্ষমতা ধরে রেখেছে। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের এমন পরিস্থিতি জাতীয় অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি। যেকোনো সময় বড় অঘটন বা আর্থিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।

তাই অন্তর্বর্তী সরকারের জরুরি ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দরে চলমান এই দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপকর্মের সিন্ডিকেট ভেঙে ফ্যাসিস্টমুক্ত বন্দর নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অন্যথায় এটি হবে জুলাই আন্দোলনের শহীদদের রক্তের প্রতি অবমাননা এবং রাষ্ট্রের প্রতি এক ভয়াবহ অবহেলা।

প্রিন্ট করুন