কোনো সরকার নাড়াতে পারবে না
টুঙ্গিপাড়ায় কোটি টাকার দুর্নীতির ‘আওয়ামী দোসর’—ভুয়া প্রকল্প, নাম-বেনামে সম্পদের পাহাড়, আর প্রশাসনিক ছত্রছায়ায় দুর্নীতির তুফান!

নিজস্ব প্রতিবেদক:
গোপালগঞ্জের টুঙ্গি- কোটালীপাড়া—একসময়ের শান্ত, স্বচ্ছ, ইতিহাসনির্ভর জনপদটি আজ ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে দুর্নীতির দুর্গে। সুনাম আর সংগ্রামের ইতিহাসের জায়গা নিয়ে নিয়েছে লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহার আর এক ভয়ানক প্রশাসনিক মাফিয়াতন্ত্র। আর এর কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন এক ‘আওয়ামী দোসর’—যিনি দলীয় নাম ভাঙিয়ে কৌশলে ঘুঁটি সাজিয়ে তৈরি করেছেন একটি অন্ধকার দুর্নীতির সাম্রাজ্য।
সরকারি প্রকল্পের নামে কীভাবে টাকা আত্মসাৎ করে কোটালীপাড়ার মাটিতে গড়ে উঠেছে কোটি টাকার বেনামী সাম্রাজ্য, সেই কাহিনি আজ প্রকাশ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিলকৃত একটি বিস্তৃত অভিযোগপত্রের মাধ্যমে।
অভিযোগ অনুসারে, কাবিখা, কাবিটা, টিআর, এলজিইডি, ইউনিয়ন পরিষদ বরাদ্দ এবং অন্যান্য সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত গড়ে তোলা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবে নেই—তবে বিল উঠেছে, টাকা গেছে ঠিকই নির্ধারিত জায়গায়। সেই জায়গার নাম—তার নিজের পকেট, আত্মীয়স্বজন, দোসরদের একাউন্ট এবং ‘অস্তিত্বহীন’ ঠিকাদারদের নামে খোলা অ্যাকাউন্টসমূহ।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি ও তার ঘনিষ্ঠজনরা মিলেই গত কয়েক বছরে শতাধিক ‘কাগুজে প্রকল্প’ থেকে কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন। প্রকল্পের কাজ নেই, অথচ কাগজে তিনবার করে বিল উত্তোলন হয়েছে। কখনো রাস্তা, কখনো কালভার্ট, কখনো সাঁকো, আবার কখনো বৃক্ষরোপণ—সবই কাগজে!
এই দুর্নীতির মূল কারিগরের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার সরপাড়া ইউনিয়নে।
এই ব্যক্তির নামে এবং আত্মীয়স্বজনের নামে জমি ক্রয়, বাড়ি নির্মাণ, গাড়ি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ফার্মহাউজ, মাছের ঘের এবং বিভিন্ন ব্যাংকে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ একটি সরকারি চাকরিজীবীর সারাজীবনের আয়ের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। অথচ তার নিজের নামে কোনো স্বচ্ছ ব্যবসা, বৈধ উপার্জনের উৎস কিংবা কর প্রদানের হিসাব নেই।
স্থানীয় প্রশাসনের একটি অংশ এই দুর্নীতির সিন্ডিকেটে ভূমিকা রাখছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। কোনো ঠিকাদার যদি কমিশন না দেয়, তাহলে তার কাজ আটকে দেওয়া হয়। আবার প্রতিবাদ করলে বা প্রশ্ন তুললে, রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার অপচেষ্টা চালানো হয়।
এই দুর্নীতির ‘আওয়ামী দোসর’ বরাবরই প্রশাসনিকভাবে অদৃশ্য ক্ষমতা দেখিয়ে চলেছেন। থানার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ওনার বিপক্ষে কেউ কথা বলতে সাহস করে না, উপরে তার ভালো সংযোগ আছে বলে শোনা যায়।”
তবে স্থানীয় সুশীল সমাজ বলছে—এই দুর্নীতির পর্দা অনেক দিন চাপা থাকলেও, এখন আর চাপা দেওয়া যাচ্ছে না। একজন মুক্তিযোদ্ধা পুত্র ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “যে লোক কোনো বৈধ আয়ের উৎস ছাড়াই এত সম্পদের মালিক হয়, তাকে আমরা কীভাবে জাতির পক্ষে ভাবি? এভাবে দেশ চাললে তো স্বাধীনতা যুদ্ধের সব অর্জন বৃথা হয়ে যাবে।”
এই দুর্নীতির কাহিনি গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর, জনমনে একধরনের হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। সাধারণ জনগণ প্রশ্ন তুলছে—সরকারি দলের দোসর হলে কি দুর্নীতি বৈধ হয়ে যায়?
দুদকে জমা অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, এই ব্যক্তির সম্পদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে অনুসন্ধান শুরু করতে হবে এবং তার ব্যাংক হিসাব, নাম-বেনামে সম্পত্তির কাগজপত্র, পারিবারিক সদস্যদের আয়কর রিটার্ন এবং সম্পদ বিবরণী যাচাই করতে হবে।
স্থানীয় এক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বলেন, “এই লোক তো এখন সবকিছুর মালিক! কেউ তাকে কিছু বললে, সে বলে – আমাকে কোনো সরকার নাড়াতে পারবে না। এই ধরণের কথা শুনে আমাদের বুক কেঁপে উঠে।”
গোপালগঞ্জের গর্বিত ভূমি আজ এই ধরনের দুর্বৃত্তদের দাপটে কলঙ্কিত। রাষ্ট্রযন্ত্র যদি এখনো নীরব থাকে, তবে মানুষই একদিন নিজের হাতে এই মাফিয়াদের বিচার করবে—এমনটাই বলছেন ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা।
দুদকের উচিত এখনই দৃঢ়ভাবে মাঠে নামা, নিরপেক্ষ তদন্ত করে এই দোসরের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র জাতির সামনে তুলে ধরা। তা না হলে এই লুটপাটের সংস্কৃতি একদিন কেবল কোটালীপাড়া নয়, গোটা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে গিলে খাবে।