ঢাকা দুই সিটি মেয়রের প্রশ্রয় লোপাট ৩ হাজার ২শ কোটি টাকা
( মোঃ মাইনুল ইসলাম মহিন. নিজস্ব প্রতিবেদক: )
গত চার অর্থবছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মেয়রের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে উন্নয়ন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে কমিশন বাবদ ৩২০০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে তৎকালীন মেয়র-কাউন্সিলর ও রাজনীতিবিদ এবং প্রকৌশলীসহ সংস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন ।
খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, দরপত্রে অটোমেশন হলেও প্রতিটি কাজ ভাগবাটোয়ারা হতো মেয়রের নির্দেশে।
সমঝোতার ভিত্তিতে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পেয়েছে। এর বিনিময়ে তারা কমিশন হিসাবে সর্বনিম্ন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত দিয়েছেন।
আর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে কমিশন আদায় হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। বিপুল পরিমাণ এই টাকা গেছে অসাধু রাজনীতিবিদ ও শাসক দল সমর্থিত আমলাদের পকেটে।
আর এই সুযোগে নিম্নমানের কাজ এবং মালামাল সরবরাহ করে অঙ্কের মুনাফা নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি)সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দৈনিক ভোরের নতুন বার্তা কে বলেন,
বিগত সরকারের সময় সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার দরপত্র ভাগাভাগি এবং কমিশন বাণিজ্যের কথা সবাই জানত। তবে এসব নিয়ে কেউ প্রশ্ন করার সাহস পেতেন না।
তিনি বলেন, গত ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অসীম ত্যাগের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি আমরা। বিগত সময়ে অনিয়ম, দুর্নীতির নির্মোহ তদন্ত হতে হবে। তাহলে প্রকৃত কারণগুলো বেরিয়ে আসবে।
এতে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা যাবে এবং দুর্নীতির উৎস বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির একাধিক প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও ঠিকাদার জানান, উন্নয়ন কাজের দরপত্রের চেয়ে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে দুর্নীতি বেশি।
বিশেষ করে গাড়ির জ্বালানি, মশার ওষুধ ক্রয়, কচুরিপানা পরিষ্কার, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কাজে লুটপাট বেশি হয়েছে। বছরের পর বছর এই ধারা চললেও তা কেউ ভাঙেনি। অবৈধ টাকার জোরে অসাধু চক্র ধরাকে সরাজ্ঞান করেন।
এমনো ঘটনা রয়েছে, একজন সৎ কর্মকর্তার এখানে পোস্টিং হওয়ার পর অসাধু চক্রের প্রলোভনে তিনিও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।ঢাকা উত্তর সিটির কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা জানান, বিগত মেয়রের চার বছরে সংস্থার অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও দরপত্রে ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে।
টাকা ছাড়া কোনো কাজ পাওয়া যায়নি। মেয়রের ঘনিষ্ঠরা এসব বাণিজ্য করেছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের জন্য এটা করতে হচ্ছে এমন কথা বলতে শোনা গেছে। বিনা টাকায় কোনো ঠিকাদার কোনো কাজ পাননি বলে তারা জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দায়িত্ব গ্রহণকরেন। এরপর ২০২১-২০২২, ২০২২-২০২৩ এবং ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটের কাজ বাস্তবায়ন করেছেন।
সবশেষ ২০২৪-২০২৫ সালের বাজেটও ঘোষণা করেন। এই সময়ে উন্নয়ন খাতে ৭ হাজার ২৫১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এখান থেকে লোপাট হয়েছে ১ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। আর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে খরচ হয়েছে ৮৬৫ কোটি টাকা।
এখানে দুর্র্নীতিবাজ চক্র হাতিয়ে নিয়েছেন ৩০৯ কোটি টাকা। কমিশন বাণিজ্যে সরকারের সর্বমোট ক্ষতি হয়েছে অন্তত ২ হাজার১৩১ কোটি টাকা। একই অবস্থা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনেও (ডিএনসিসি)। মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এরপর ২০২১-২০২২, ২০২২-২০২৩ এবং ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটের বাস্তবায়ন করেছে। সবশেষ ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাও করেন। গত চার বছরে উন্নয়ন খাতে খরচ করেছে ৩ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। এখানে লোপাট হয়েছে ৮৭৩ কোটি টাকা।
পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে খরচ হয়েছে ৫৭৮ কোটি টাকা। আর এখানে কমিশন বাবদ দুর্নীতিবাজ চক্রহাতিয়ে নিয়েছে ২৩০ কোটি টাকা। তবে ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের ফলে দেশে বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় দুই মেয়র বরখাস্ত হয়েছেন।
তারা এখন পলাতক রয়েছেন।সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে মেয়র তাপসের নির্দেশে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাজ দিতেন প্রকৌশলীরা। নামে ই-টেন্ডারিং হলেও বাস্তবে মেয়রের নির্দেশেই সবকিছু হতো।
রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ ভাগবাটোয়ারা করলেও মেয়র এসব কাজ থেকে কোনো কমিশন নিতেন না। যিনি কাজ পেতেন তিনি নিজে পেশাদার ব্যবসায়ী না হওয়ায় ১০ ভাগ কমিশন নিয়ে তা অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছেন। ওই কাজগুলো দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা অন্য ঠিকাদারদের সমন্বয় করে দেওয়া বাবদ ২ ভাগ কমিশন নিয়েছেন।
আর বাকি ১৩ভাগ কমিশন দিতে হয়েছে উপসহকারী প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, সচিব, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, কাউন্সিলর এবং হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
তবে ওই সময়ে দায়িত্ব পালন করা প্রধান প্রকৌশলী কমিশন নিতেন না। এছাড়া কাজ পাওয়া এবং বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত বেশির ভাগ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কমিশন নিয়েছেন বলে জানা যায়। মেয়রের নির্দেশে কাজ ভাগাভাগি হওয়ার কারণে দক্ষিণ সিটির অধিকাংশ দরপত্রে কোনো প্রতিযোগিতা হয়নি।
সমঝোতার ভিত্তিতে অনেক দরপত্রে ঠিকাদাররা অংশ নিতেন বলে জানা যায়।
একই অবস্থা বিরাজমান ছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনেও।
গুটিকয়েক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঘুরেফিরে কাজ পেত সেখানে। বিভিন্ন রাজনৈতিক চাপের কাছে কাবু ছিলেন তৎকালীন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
সংশ্লিষ্টদের খুশি করতে তার নির্দেশে গোপন দর ফাঁস করে কাজ পাইয়ে দেওয়া হতো। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরাও এসব ক্ষেত্রে অসহায়বোধ করতেন।
তবে অধিকাংশই এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে খুশিমনে কমিশন বাণিজ্য করেছেন। রাজনৈতিক কাজগুলো মূলত মেয়রের নামে চলেছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের এবং রাজনৈতিক দলের বিভিন্নপর্যায়ের সন্তুষ্টি অর্জনের পেছনে শত শত কোটি টাকার কাজ ভাগবাটোয়ারা হয়েছে ঢাকা উত্তরে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ পাওয়া ব্যক্তিরা ঠিকাদারদের কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ ভাগ কমিশন আদায় করতেন। ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি।
আর বাকি কমিশন কাউন্সিলর থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, প্রকৌশলীরা নিয়েছেন। তবে ঢাকা উত্তর সিটির বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা ছিলেন; যারা মেয়রের নির্দেশে কাজ করলেও কোনো কমিশন নিতেন না।
কর্তৃপক্ষের অভিমত : এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান দৈনিক ভোরের নতুন বার্তাকে বলেন, অডিট আপত্তি বা সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ না পেলে পুরাতন ঘটনার তদন্ত করছেন না তারা।
তবে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে তখন সেসব বিষয় তদন্ত করে দেখবে বলে জানান। এছাড়া দুর্নীতির ঘটনাগুলো তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উদ্যোগী হওয়া দরকার বলে অভিমত তার।
এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করবেন তারা।এ বিষয়ে জানতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা (এসএসএম) পাঠালেও কোনো সাড়া মেলেনি।