আশিকুর রহমান :
নরসিংদীর রায়পুরায় প্রতিপক্ষের হাতে একই পরিবারের দুজনকে হত্যা দায়ের করা মামলায় আপস না করায় কি জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে? এমন প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। আর এমনটাই মনে করেন এলাকাবাসী। প্রতিপক্ষের হাতে হত্যা শিকার কামাল ও মাসুদ হত্যার বাদী মানিক মিয়া (৫৫) ও তার ভাগনি কল্পনা বেগম (২৫)।
গত বছরের ৭ ডিসেম্বর (শনিবার) ভোরে উপজেলার চান্দেরকান্দি ইউনিয়নের নজরপুর গ্রামে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর থেকেই রায়পুরা পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হারুন অর রশিদ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে রয়েছেন। অপরদিকে আরেক আসামী উপজেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাছেদ মেম্বার রয়েছেন আত্মগোপনে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল মানিক মেম্বারকে হারিয়ে স্ত্রী ও স্বজনরা পাগলপ্রায়। ঘরের ভেতরে উপস্থিত সবার চোখে পানি। নিহত মানিকের স্ত্রীর কান্না ও বিলাপে ভারী হয়ে উঠছিল পরিবেশ। মেঝেতে বসা জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভোগা ছেলে ফুপিয়ে কাঁদছেন। মামলার বাদী ও মানিক মিয়ার স্ত্রী জাহানারা বলেন, আমার স্বামী জীবনে কোনো অন্যায় কাজ করে নাই। এমন শোক আমি কেমনে বইবো।
কলিজা ছিঁড়ে সংসারের একমাত্র উপার্জন ব্যক্তিটা যে চইলা গেছে। আমার স্বামীরে অনেক বুঝাইলাম পায়ে হাতে ধরে বললাম। তুমি কোর্টে স্বাক্ষী দিতে যেও না। কত কষ্ট করে আমাদের সংসার চলে, যদি কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে আমাদের সংসার কে দেখবে? তুমি কোন ভাবে আর কোর্টে যাবে না। এও বলছি, তোমার যদি কিছু হয়ে যায় আমরা আর বাঁচমু না।
আমার সন্তানরাও তারে বুঝাইছে। ছেলে বলছে তুমি পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। কোর্টে গিয়ে স্বাক্ষী দিও না। সবার কথা খালি চুপ কইরা শুনল। একটা বারও মনে করল না, আমি যদি না বাঁচি তাহলে আমার সংসার দেখবো কেডা। বলতে বলতে জাহানারা বার বার মোর্চা যাচ্ছিলেন।
নিহত কল্পনা বেগমের শাশুড়ি হেলেনা বেগম বলেন, মেথিকান্দা এলাকার হারুন অর রশিদ, বাছেদ মেম্বার ও নান্নু হাজীর নামে হত্যা, হুমকি, অস্ত্র, বিস্ফোরক, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ সহ রায়পুরা থানা ও নরসিংদীর আদালতে প্রায় ১২টি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে রায়পুরার আলোচিত কামাল ও মাসুদ হত্যা মামলা দুটি আদালতে স্বাক্ষী পর্যায়ে রয়েছে।
‘মামলা আপসের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তারা মানিক মেম্বারকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে এবং গুলি ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এসময় আমার ছেলের বউ কল্পনা বেগমকেও গুলি করে তারা হত্যা করে। তিনি আরও বলেন, মানিক মেম্বার চান্দেরকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। সে মাসুদ ও কামাল হত্যা মামলার বাদী ছিলেন।
অনুসন্ধান ও থানা সূত্রে জানা যায়, গত ২০০৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারী রাত আনুমানিক ৮টার দিকে রায়পুরা উপজেলার শ্রীরামপুর বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে মানিক মিয়া (মেম্বার), হযরত আলী, কামাল ও মাসুদ মিয়া পঁচাবোয়ালিয়া এলাকায় পৌঁছালে লিয়াকত আলী ওরফে লইক্কা মিস্ত্রির ছেলে হারুন অর রশিদ,
নুর মোহাম্মদ, দুলাল সহ আরও ১৫/২০ জন তাদের পথরোধ করে কামাল মিয়াকে কুপিয়ে গুরুত্বর আহত করে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এঘটনার ২ মাস পার না হতেই উক্ত আসামীরা একই বছরের ২৬ এপ্রিল দুপুর আড়াইটায় শ্রীরামপুর মধ্যেপাড়া গ্রামের আঃ হালিম প্রিন্সিপালের বাড়ির সামনে মানিক ডাক্তারের বাড়ির ভিতর ঢুকে কামাল মিয়াকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে।
উক্ত দুটি হত্যাকান্ডে তৎকালীন সময়ে নিহত মানিক মিয়া বাদী হয়ে রায়পুরা থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। রায়পুরা থানা মামলা নং ০৪/২০০৪ তাং- ৮/২/২০০৪ ও ২২/২০০৪ তাং- ২৬/৪/২০০৪। পরে থানা পুলিশ দীর্ঘ তদন্তের করে উপরোক্ত আসামিরা ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত থাকায় প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। উক্ত মামলায় আসামীরা দীর্ঘদিন জেল খেটে জামিনে বের হোন।
পরে আদালত আসামীদের বিরুদ্ধে স্বাক্ষী তলব করলে বাদী সহ বেশ কয়েকজন স্বাক্ষী আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য প্রদান করেন। এতে করে আসামীরা বাদীর উপর বেপরোয়া ও হিংসাত্মক হয়ে উঠেন।
বাদী পক্ষের আইনজীবী একেএম মনির হোসেন বলেন, নিহত মানিক নরসিংদী আদালতে চলমান ২টি হত্যা মামলার বাদী ছিলেন।
দুটি মামলাই অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-১ ও ২ এ পৃথক পৃথক মামলায় সাক্ষী অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত দায়রা জজ-১ আদালতে মাসুদ হত্যা মামলা গত ৮ ডিসেম্বর (রবিবার) বাদী সাক্ষ্যের দিন ধার্য্য ছিল। আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় বাদীকে হত্যা গুরুত্বর অপরাধ। মাসুদ হত্যা মামলার বাদীকে হত্যার ঘটনা নেক্করজনক ঘটনা।
এটা ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। কোনো হত্যা সংগঠিত হলে ভিকটিমের পরিবার বা সদস্য বিচার প্রার্থনায় আদালতে দারস্থ হয়। ন্যায় বিচারের স্বার্থে বাদীকে সকল প্রকার সহযোগিতা করবে রাস্ট্র।
তার বাদী যদি বিবাদীর হাতে খুন হন তাহলে ন্যায় বিচারে বাধাগ্রস্ত হবে বলে আমি মনে করি। নিহত মানিক মিয়ার ছেলে কাওসার জানান, ২০ বছর আগে লইক্কা মিস্ত্রির বাড়ির লোকজন আমার দুই চাচাকে গুলি ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
এই নৃশংস হত্যাকান্ডের মূল নায়ক হারুন, বাছেদ মেম্বার ও দুলাল। আর এ হত্যা মামলার বাদী ছিলেন আমার বাবা। আমার চাচা হত্যা মামলার আপোষ করতে আমার বাবা ও আমাদের পরিবারকে অনবরত চাপ ও হুমকি দিয়ে আসছিলেন তারা।
কিন্তু আমার বাবা ছিলেন আপোষহীন একজন মানুষ। সত্য ও ন্যায়ের পথে ছিলেন তিনি অবিচল। তাদের হুমকি-ধমকি তোয়াক্কা না করে তিনি আদালতে স্বাক্ষী দিয়েছিলেন। তাই আজ তার এই পরিনতি। তিনি আরও বলেন, একটা খুনকে আড়াল করতে আজ তারা আরও দুটি খুন করেছে।
এভাবে চলতে থাকলে খুনের রাজত্ব কায়েম হবে সর্বত্রে। তাই আমি একজন পিতৃহারা সন্তান হিসেবে প্রশাসনের নিকট প্রার্থনা করছি দ্রুত খুনিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নিহত মানিক মেম্বার একজন সহজ সরল ও উদার স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনও মাথা নত করেনি। তার ভাই মাসুদ ও কামালকে হত্যা করে লইক্কা মিস্ত্রি বাড়ির লোকজন। এ ঘটনার পর লইক্কার বাড়ির লোকজন বেশ কয়েকবার আপোষ করতে চেয়েছিল। কিন্তু মানিক এতে সাড়া দেননি।
সাড়া না দেওয়ার কারণে এর আগেও লইক্কার বাড়ির লোকজন বেশ কয়েকবার মানিক ও তার পরিবারের উপর হামলা চালিয়ে ছিল। এর জের ধরে গত শনিবার ৭ ডিসেম্বরের লইক্কা বাড়ির হামলায় মানিক মেম্বার ও তার ভাগনি কল্পনা বেগম নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। মানিক চান্দেরকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান সদস্য এবং কল্পনা বেগম একই গ্রামের আবু ছালেকের স্ত্রী।
পূর্ববিরোধের জেরে ভোরে লইক্কা মিস্ত্রির ছেলে হারুন-অর-রশিদ ও বাছেদ মেম্বারের নেতৃত্বে কয়েকশ লোক আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মানিক মেম্বারের উপর আতর্কিত এ হামলা চালায়। এসময় উভয় পক্ষই মারামারিতে জড়িয় পড়েন।
হামলা থেকে বাঁচতে এসময় মানিক মেম্বার পাশ্ববর্তী বশির উদ্দিনের বাড়ির ঘরে ভিতর আশ্রয় নিলে সেখান থেকে তারা তাকে ঘর থেকে টেনে বাইরে এনে গুলি করে এবং কুপিয়ে দেহ থেকে তার পা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয় বলে জানা এলাকাবাসী। এসময় প্রাণ হারান মানিকের ভাগনি কল্পনা বেগম নামে আরেক নারী।
সত্তোর বয়সী বৃদ্ধা মহিলা জানান, ফজরের নামাজ শেষ করে উঠানের দিকে গেলে দেখি হারুনের লোকেরা বন্দুক, রামদা, চাপাতি, টেঁটা হাতে কয়েকশ লোক নিয়ে মানিক মেম্বারের বাড়ির দিকে যাইতাচ্ছে। গ্রামের অনেক মানুষ তখন ঘুমিয়ে ছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা এ হামলা করে।
রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আদিল মাহমুদ বলেন, রায়পুরার নজরপুরে আধিপত্য বিস্তার ও পূর্বশত্রুতা জের ধরে জোড়া খুনের ঘটনার অভিযোগে এজাহারভুক্ত ২নং আসামী হারুন-অর-রশিদকে গত ৫ জানুয়ারী থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। বাকি আসামীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।