ডিপিডিসিতে আওয়ামী দোসর প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাক | পর্ব -০১

নিজস্ব প্রতিনিধি:
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)-এর এক প্রকৌশলী, শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার হাসলীগাঁও গ্রামের সন্তান আব্দুর রাজ্জাক—একদিকে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত দানবীর, অন্যদিকে সরকারি কাঠামোর আড়ালে গড়ে তোলা দুর্নীতির অবিশ্বাস্য এক সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে থাকা বিতর্কিত নাম। সরকারি প্রকৌশলীর সীমিত বেতন দিয়ে শতকোটি টাকার সম্পদের পাহাড় কীভাবে গড়ে উঠল, সে প্রশ্নে আজ জনমনে দানা বাঁধছে বিস্ময় ও ক্ষোভ।
হাসলীগাঁও গ্রামে দাঁড়িয়ে থাকা দৃষ্টিনন্দন দোতলা মসজিদ, মাদ্রাসা, পাঁচ একর জমির ওপর বিলাসবহুল বাড়ি, মাছের খামার—সব মিলিয়ে আব্দুর রাজ্জাক নিজেকে একজন দানবীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অথচ এসব সম্পদের উৎস নিয়ে রয়েছে গুরুতর অভিযোগ। অভিযোগ অনুযায়ী, নিজের মালিকানাধীন কোম্পানি ‘ওসাকা পাওয়ার লিমিটেড’-এর নিম্নমানের সাব-স্টেশন ও ট্রান্সফরমার জোরপূর্বক গ্রাহকদের কিনতে বাধ্য করে তিনি গড়ে তুলেছেন এই বিলাসবহুল জীবনযাত্রা।
মগবাজার ডিভিশনে উপসহকারী প্রকৌশলী পদে থাকাকালেই নিয়ম ভেঙে বিশেষ পন্থায় এক লাফে দুই ধাপ এগিয়ে তিনি হন সিদ্ধিরগঞ্জ ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী। এরপর ভাকুর্তা এলাকায় ৩০ কাঠা জমিতে নির্মাণ করেন ‘ওসাকা পাওয়ার লিমিটেড’-এর সাব-স্টেশন কারখানা, যার স্বরূপ এখন আর বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট নয়—ভাড়া দেওয়া হয়েছে কাঠের দরজার কারখানাকে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে চন্দ্রিমা মডেল টাউনে দুটি বহুতল ভবন, গাজীপুরে বহুতল ভবন, শেরপুর শহরের তিনআনি বাজারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোতলা ভবন, দীঘারপাড়ে ছয় একর জমির ওপর মাছের খামার, আর দুটি পলিটেকনিক—এসবই আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা।
২০১৬ সালের এক প্রকল্পে ওসাকার ৩০০ ট্রান্সফরমার সরবরাহ করা হলে ১৯১টিকে চিহ্নিত করা হয় সম্পূর্ণ মানহীন হিসেবে। পরিণামে বিভিন্ন এলাকায় এসব ট্রান্সফরমারের কারণে ঘটে অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির ঘটনা। ডিপিডিসির উপসহকারী প্রকৌশলীর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, তারা জানতেন এসব ট্রান্সফরমার ঝুঁকিপূর্ণ, তবু গ্রাহকদের বাধ্য করতেন সেগুলো কিনতে। তদন্তে দায়ী হিসেবে উঠে আসলেও রাজ্জাকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
২০২২ সালে দায়ের হওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে গঠিত তদন্ত কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন ডিপিডিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আবু হেনা মোস্তফা কামাল। আটজনকে অভিযুক্ত করে রিপোর্ট দেওয়া হলেও শুধুমাত্র প্রধান অভিযুক্ত রাজ্জাক থেকে যান বহির্ভূত। বরং সেই তদন্তের খেসারত হিসেবে মোস্তফা কামাল পদোন্নতির ক্ষেত্রে বঞ্চিত হন, তার জুনিয়রকে করা হয় প্রধান প্রকৌশলী। তার ভাষায়, “এই তদন্ত কমিটিতে থাকায় আমি সাফারার।”
আব্দুর রাজ্জাক নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে, যার ছত্রচ্ছায়ায় বদলি, পদোন্নতি, নিয়োগ—সবই নিয়ন্ত্রণ করতেন। ঢাকার অনুষ্ঠান হোক কিংবা শেরপুর-ময়মনসিংহে কোনো সমাবেশ—ডিপিডিসির প্রকৌশলীদের থেকে নিয়মিত বড় অঙ্কের চাঁদা তুলতেন। এমনকি ১৫ আগস্ট বদলির আদেশ জারি হলেও ২৬ দিনের মাথায় বাতিল করে আবার পুরোনো পদে ফেরানো হয় তাঁকে। আর প্রকৌশলীদের বিক্ষোভে সেই দিনই তাকে বদলি করা হয় ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে।
রাজধানীর পান্থপথে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রীকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বানিয়ে গড়ে তোলেন করপোরেট অফিস। ওসাকার নামে সরবরাহ করা নিম্নমানের সরঞ্জাম দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এই টাকা দিয়েই তিনি হয়েছেন ‘দানবীর রাজ্জাক’—মসজিদ-মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক, অথচ ভেতরে এক নিষ্ঠুর সিন্ডিকেটপ্রধান।